১২ অক্টোবর ২০২৫, রবিবার, ০০:৫৭

শিরোনাম উপদেষ্টাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন মির্জা ফখরুল Logo জুলাই সনদ স্বাক্ষরের তারিখ পেছালো Logo শিক্ষা হচ্ছে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাত্রা: কাদের গনি চৌধুরী Logo ওয়ারেন্টভুক্ত ১৫ সেনা কর্মকর্তা হেফাজতে, হদিস নেই একজনের: সেনা সদর Logo শাহজালালে অবতরণের সময় চাকার সঙ্গে ঢুকে পড়ল শিয়াল Logo প্রধান বিচারপতির বাসভবন ও আশপাশের এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ Logo ১৬ অক্টোবর চারুকলার বকুলতলায় হবে শরৎ উৎসব Logo রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়াই গণভোটের সুযোগ আছে: বদিউল আলম Logo

স্বর্ণের দাম: কেন বাড়ছে সোনার মূল্য এবং এর পেছনের আসল কারণ

স্বর্ণের দাম: কেন বাড়ছে সোনার মূল্য এবং এর পেছনের আসল কারণ

প্রকাশিত: ০৯ অক্টোবর, ২০২৫, ১৮:২০

আমাদের সমাজে এমন খুব কম জিনিস আছে যেটার প্রতি মানুষের আগ্রহ যুগের পর যুগ ধরে একই রকম রয়ে গেছে, স্বর্ণ তার মধ্যে অন্যতম। বাড়িতে কোনো বিয়ে বা উৎসব মানেই স্বর্ণ কেনার ধুম। মা বা খালার স্বর্ণের গয়নার বাক্স যেন একেকটা ঐতিহাসিক স্মৃতির পাত্র। শুধু সৌন্দর্যের জন্য নয়, স্বর্ণকে বরাবরই ধরা হয় নিরাপদ সম্পদ হিসেবে।

স্বর্ণের প্রতি এই ভালোবাসা শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর প্রায় সব সংস্কৃতিতেই সোনার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। হিন্দু বিয়ে হোক কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের উপহার সংস্কৃতি, সবখানেই সোনা এক সম্মানের প্রতীক। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময় মানুষ যখন ব্যাংকে টাকা রাখতে ভয় পায়, তখন তারা ভরসা রাখে সোনার উপর। এটাই সোনাকে অন্য যেকোনো পণ্য থেকে আলাদা করে।

স্বর্ণ কখনো শুধু ধাতু ছিল না—এটা ছিল রাজপ্রাসাদের গর্ব, যুদ্ধের লুট, কিংবা প্রেমের প্রতীক। ইতিহাস ঘাটলেই দেখা যায়, রোমান সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে মোগল দরবার—সবখানে স্বর্ণের ছিল অবিসংবাদিত আধিপত্য।

স্বর্ণের দাম নিয়ে মানুষের মধ্যে প্রশ্ন, উদ্বেগ, আর জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। অনেকেই জিজ্ঞেস করছেন, “স্বর্ণের দাম এত বাড়ছে কেন?”, “এখন কিনবো, না আরও কমার অপেক্ষা করবো?”, “২১ ক্যারেট না ২২ ক্যারেট, কোনটা লাভজনক?”এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পারেন বিস্তারিত, তথ্যভিত্তিক এবং অভিজ্ঞতানির্ভর আজকের লেখায়।

এই লেখাটি আপনাকে স্বর্ণ সম্পর্কে আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করবে এবং আপনি নিজের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।

স্বর্ণের দাম এত বেশি কেন?

স্বর্ণের দাম কেন এত বেশি, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে কেবল সৌন্দর্য বা ঐতিহ্যের দিক থেকে নয়, অর্থনীতির দিক থেকেও বিষয়টি দেখতে হয়। 

সোনা এমন একটি মূল্যবান ধাতু, যার সরবরাহ সীমিত কিন্তু চাহিদা সবসময়ই বেশি। ঠিক এই কারণেই সোনার দাম শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে উচ্চ পর্যায়ে থেকেছে।

সোনার প্রকৃত মূল্য নির্ধারিত হয় কীভাবে?

স্বর্ণের প্রকৃত দাম বা সোনার দাম কত হবে তা মূলত আন্তর্জাতিক বাজারেই ঠিক হয়। লন্ডন বুলিয়ন মার্কেট অ্যাসোসিয়েশন (LBMA) ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক স্বর্ণ বাণিজ্য বাজারে প্রতিদিন সোনার দাম ওঠানামা করে। 

বাংলাদেশে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (BAJUS) আন্তর্জাতিক বাজারের দামের ওপর ভিত্তি করে ভরিপ্রতি স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করে।

এছাড়াও, স্বর্ণের ক্যারেট অনুযায়ী দামের পার্থক্য হয়। যেমন ২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম সবসময় ২১ ক্যারেটের চেয়ে বেশি।

স্বর্ণ উৎপাদনের জটিলতা ও খরচ

স্বর্ণের দাম কেবল চাহিদার কারণে বেশি নয়, উৎপাদনের জটিলতা ও ব্যয়বহুল প্রক্রিয়াও এর একটি বড় কারণ। পৃথিবীর খুব অল্প কিছু দেশে বড় আকারে সোনা খনন করা হয়। যা অনেক গুলো ধাপ পার করে বিক্রির জন্যে প্রস্তুত করা হয়, যেমন -

  • মাটির গভীর থেকে স্বর্ণ আহরণ
  • প্রসেসিং ও পরিশোধন (Refining)
  • পরিবহন ও সংরক্ষণের খরচ

এসব মিলিয়ে এক ভরি স্বর্ণ বাজারে পৌঁছাতে প্রচুর খরচ হয়। তাই প্রাকৃতিকভাবেই এর দাম উঁচুতে থাকে।

সোনার চাহিদা বনাম সরবরাহ

অর্থনীতির একটি সাধারণ নিয়ম হলো—চাহিদা যত বেশি, সরবরাহ যত কম, দাম তত বেশি।
স্বর্ণের ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে।

  • প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী স্বর্ণের চাহিদা বাড়ছে
  • বিশেষত ভারত, চীন, মধ্যপ্রাচ্য ও বাংলাদেশে স্বর্ণ কেনার প্রবণতা বেশি
  • কিন্তু পৃথিবীর স্বর্ণখনি থেকে আহরণ সীমিত

এই চাহিদা-সরবরাহের ভারসাম্যহীনতা স্বর্ণের দাম ক্রমাগত বাড়িয়ে দিচ্ছে। তার ওপর বিশ্ব অর্থনীতির অস্থিরতা, মুদ্রাস্ফীতি আর বৈদেশিক মুদ্রার দরপতনের কারণে মানুষ টাকা না রেখে স্বর্ণে বিনিয়োগ করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এতে স্বর্ণের চাহিদা আরও বেড়ে যায় আর দামও বাড়তে থাকে।

বর্তমানে স্বর্ণের দাম বাড়ছে কেন?

যদি আপনি নিয়মিত বাজারের খবর রাখেন, তাহলে নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন যে সাম্প্রতিক সময়ে স্বর্ণের দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছে। অনেকে ভাবছেন, এটা কি সাময়িক বৃদ্ধি, নাকি দীর্ঘমেয়াদে সোনার দাম আরও বাড়বে?

আসলে এর পেছনে রয়েছে কিছু অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও বাজারভিত্তিক কারণ, যা বিশ্বজুড়ে স্বর্ণের দামে প্রভাব ফেলছে।

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা

বিশ্ব অর্থনীতি এখন এক অনিশ্চিত সময় পার করছে। কোভিড পরবর্তী মন্দা, বাণিজ্যযুদ্ধ, ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা, সবকিছু মিলিয়ে মানুষ তাদের অর্থ সুরক্ষিত রাখার উপায় খুঁজছে।

এই সময় বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজার বা ক্রিপ্টোকারেন্সির মতো ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় না গিয়ে স্বর্ণে বিনিয়োগকে বেশি নিরাপদ মনে করছেন।

অর্থনীতির ভাষায় একে বলা হয় “safe haven investment", অর্থাৎ নিরাপদ আশ্রয়। এই প্রবণতাই স্বর্ণের দাম বাড়ার অন্যতম প্রধান কারণ।

মুদ্রাস্ফীতি (Inflation)

যখন বাজারে দ্রব্যমূল্য বাড়ে, তখন টাকার ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। অর্থাৎ, আজকের ১০০০ টাকা দিয়ে যেটা কেনা যাচ্ছিল, কয়েক মাস পর সেটা কিনতে আরও টাকা লাগবে।

এই অবস্থায় মানুষ চায় এমন একটি সম্পদ, যার মূল্য সময়ের সাথে কমে না, স্বর্ণ তার সেরা উদাহরণ।
তাই মুদ্রাস্ফীতি যত বাড়ে, স্বর্ণের দামও তত বাড়ে। কারণ মানুষ টাকা না রেখে সোনায় বিনিয়োগ করে, ফলে চাহিদা বৃদ্ধি পায়।

বৈদেশিক মুদ্রার দরপতন (বিশেষ করে মার্কিন ডলার)

স্বর্ণের দাম মূলত মার্কিন ডলারে নির্ধারিত হয়। যখন ডলারের মান কমে যায়, তখন অন্য দেশের ক্রেতাদের জন্য স্বর্ণ তুলনামূলকভাবে সস্তা হয়ে যায়, ফলে তারা বেশি কেনেন।

এই অতিরিক্ত চাহিদা আবার সোনার দামকে উপরে ঠেলে দেয়।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, ডলারের বিপরীতে টাকার দর কমে গেলে স্বর্ণ আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়, যা ভ্যন্তরীণ বাজারে দামের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।

বৈশ্বিক রাজনৈতিক টেনশন ও যুদ্ধ পরিস্থিতি

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিতিশীলতা, চীন-তাইওয়ান উত্তেজনা—এসব কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

ইতিহাস বলছে, যুদ্ধ বা রাজনৈতিক সংকটের সময় স্বর্ণের দাম প্রায় সবসময়ই বাড়ে। কারণ মানুষ অন্য বিনিয়োগ থেকে সরে এসে সোনায় টাকা রাখে।

বাংলাদেশের (Bangladesh) প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশেও গত কয়েক বছরে স্বর্ণের দাম আজকের বাজারে রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কারন -

  • আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ছে
  • ডলারের সংকট ও আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি
  • স্থানীয় বাজারে জুয়েলারি চাহিদা বৃদ্ধি

এই সব মিলিয়ে স্বর্ণের দাম বর্তমানে কত হবে তা প্রায় প্রতিদিনই পরিবর্তন হচ্ছে। বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (BAJUS) প্রায় প্রতি সপ্তাহেই দাম আপডেট করছে।

সংক্ষেপে বলা যায়, স্বর্ণের দাম বাড়ছে কারণ এটি এখনো নিরাপদ বিনিয়োগের প্রতীক, যেখানে অর্থনীতি অস্থির, ডলারের মান কমছে, আর বিশ্ব রাজনীতি অনিশ্চিত।

২১, ২২, ১৮ ক্যারেট ও শনাতন সোনার দামের পার্থক্য

বাংলাদেশে গয়না কেনার সময় সবচেয়ে সাধারণ প্রশ্নগুলো হলো –

  • ২১ ক্যারেট না ২২ ক্যারেট নিব?
  • শনাতন সোনার দাম কেন কম?
  • ১৮ ক্যারেট সোনা কি ভালো?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে হলে আগে বুঝতে হবে, ক্যারেট মানে কী এবং প্রতিটি ধরণের সোনার পার্থক্য কোথায়।

ক্যারেট মানে কী?

সোনার বিশুদ্ধতার পরিমাণ নির্ধারণের একক হলো ক্যারেট (Karat)।

  • ২৪ ক্যারেট = ১০০% বিশুদ্ধ সোনা
  • ক্যারেট যত কমে, ধাতব মিশ্রণ তত বাড়ে

গয়না তৈরিতে সাধারণত ১৮, ২১, ও ২২ ক্যারেট সোনা ব্যবহৃত হয়। ২৪ ক্যারেট সোনা খুব নরম হওয়ায় এটি সাধারণত মুদ্রা বা বার আকারে রাখা হয়, গয়না তৈরিতে নয়।

বিভিন্ন ক্যারেট ও শনাতন সোনার তুলনামূলক পার্থক্য

সোনার ধরণ

বিশুদ্ধতার হার

ধাতব মিশ্রণ

ব্যবহার

দাম (২০২৫ সালের আনুমানিক)

মন্তব্য

১৮ ক্যারেট

প্রায় ৭৫%

বেশি

ডিজাইন জুয়েলারি, হালকা গয়না

তুলনামূলক কম

টেকসই কিন্তু উজ্জ্বলতা কম

২১ ক্যারেট

প্রায় ৮৭.%

মাঝারি

চেইন, আংটি, ব্রেসলেট

মাঝারি

টেকসই জনপ্রিয়

২২ ক্যারেট

প্রায় ৯১.৬৭%

কম

ব্রাইডাল সেট, ইনভেস্টমেন্ট

বেশি

বিশুদ্ধতা মূল্য বেশি

শনাতন

৮০৮৩%

বেশি

ঐতিহ্যবাহী গয়না

তুলনামূলক কম

স্থানীয়ভাবে মিশ্রিত, মান নির্ভর করে কারিগরের উপর

শনাতন সোনা কী?

শনাতন সোনা হলো আমাদের দেশের প্রথাগত পদ্ধতিতে তৈরি সোনা।

এটি নির্দিষ্ট ক্যারেটের নয়, বরং স্থানীয়ভাবে মিশ্রণ নির্ভর সোনা, যেখানে বিশুদ্ধতা ৮০%–৮৩% পর্যন্ত হতে পারে।

এই কারণে শনাতন সোনার দাম তুলনামূলকভাবে কম, কিন্তু বাজারে পুনরায় বিক্রির সময় এর দাম কমে যেতে পারে, কারণ এটি স্ট্যান্ডার্ড ক্যারেটভিত্তিক নয়।

বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম কিভাবে নির্ধারিত হয়?

অনেকেই ভাবেন, বাজারে যে স্বর্ণের দাম ওঠানামা করে, সেটা কি জুয়েলারি দোকান মালিকরা নিজেরা ঠিক করে দেন?

আসলে বিষয়টা তেমন নয়।

বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম নির্ধারণের একটা নির্দিষ্ট কাঠামো ও প্রক্রিয়া আছে, যা আন্তর্জাতিক বাজার, আমদানি খরচ, ডলার দর, এবং করনীতির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (BAJUS)-এর ভূমিকা

বাংলাদেশে স্বর্ণের দামের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (BAJUS)।

এরা প্রতিদিন বা সপ্তাহে একাধিকবার আন্তর্জাতিক স্বর্ণবাজারের পরিবর্তন বিশ্লেষণ করে নতুন দাম নির্ধারণ করে।
BAJUS সাধারণত নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনা করে দাম ঠিক করে:

  • আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম
  • ডলারের বিনিময় হার
  • স্বর্ণ আমদানির খরচ (শুল্ক, ট্যাক্স, পরিবহন)
  • স্থানীয় বাজারে চাহিদা ও সরবরাহ
  • ব্যাংক ও আর্থিক নীতিমালা পরিবর্তন

প্রতিবার দাম নির্ধারণের পর BAJUS সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে “আজকের স্বর্ণের দাম”প্রকাশ করে।

আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব

বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম একদমই আন্তর্জাতিক বাজারের উপর নির্ভরশীল।

উদাহরণস্বরূপ, যদি লন্ডন বা দুবাইয়ের বাজারে প্রতি আউন্স সোনার দাম ৫% বেড়ে যায়, তবে বাংলাদেশেও তার প্রভাব সঙ্গে সঙ্গে পড়ে।

এই কারণেই অনেক সময় দেখা যায়, বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার পরদিনই দেশে স্বর্ণের দাম ভরিতে ২,০০০–৩,০০০ টাকা বেড়ে যায়।

ডলারের দাম ও আমদানি শুল্ক

স্বর্ণ আমদানি করতে হয় ডলারে, তাই ডলারের বিনিময় হার যত বাড়ে, স্বর্ণের দামও তত বাড়ে।

উদাহরণস্বরূপ, একসময় ১ ডলার = ৮৫ টাকা ছিল, এখন যদি সেটা ১২০ টাকায় পৌঁছায়, তবে একই পরিমাণ সোনা কিনতে অনেক বেশি টাকা দিতে হয়।

এছাড়া, সরকার আমদানি শুল্ক (Import Duty) হিসেবে প্রায় ১৫–২০% পর্যন্ত কর নেয়, যা সরাসরি ভোক্তা পর্যায়ে দামের ওপর প্রভাব ফেলে।

স্থানীয় চাহিদা ও মৌসুমি প্রভাব

বাংলাদেশে বিয়ে, ঈদ, পূজা বা উৎসবের মৌসুমে স্বর্ণের চাহিদা বেড়ে যায়।
এই সময় জুয়েলারি দোকানগুলোতে বিক্রি বাড়ে, ফলে চাহিদা-সরবরাহের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে দাম সামান্য বেড়ে যায়।

আবার মৌসুম শেষে চাহিদা কমলে দাম কিছুটা স্থিতিশীল হয়।

অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও নীতিগত প্রভাব

যখন দেশে মুদ্রাস্ফীতি বা অর্থনৈতিক চাপ বেড়ে যায়, তখন সাধারণ মানুষ টাকায় আস্থা না রেখে স্বর্ণে বিনিয়োগ করতে শুরু করে।

এই বিনিয়োগের প্রবণতা বাড়লে বাজারে চাহিদা বৃদ্ধি পায়, এবং ফলস্বরূপ দামও বেড়ে যায়।

অন্যদিকে, যদি সরকার আমদানির নীতিতে পরিবর্তন আনে বা ট্যাক্স কমায়, তাহলে স্বর্ণের দাম কিছুটা কমতেও পারে।

স্বর্ণে বিনিয়োগ: লাভজনক না ঝুঁকিপূর্ণ?

আমাদের দেশে অনেকেই মনে করেন, স্বর্ণ কিনলে কখনো ক্ষতি হয় না। এক অর্থে কথাটা সত্যি, কিন্তু পুরোপুরি নয়।

স্বর্ণে বিনিয়োগ সত্যিই লাভজনক হতে পারে, যদি আপনি সঠিক সময়ে, সঠিক উপায়ে এবং সঠিক উদ্দেশ্যে করেন।

জেনে নেয়া যাক, কেন স্বর্ণে বিনিয়োগ করা হয়, আর এতে কী ধরনের ঝুঁকি আছে।

কেন মানুষ স্বর্ণে বিনিয়োগ করে?

১। নিরাপত্তার প্রতীক

অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময় স্বর্ণকে বলা হয় “Safe Haven Asset” অর্থাৎ নিরাপদ আশ্রয়।

যখন শেয়ারবাজার পড়ে যায়, ডলারের মান ওঠানামা করে, বা মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায়, তখন মানুষ টাকার পরিবর্তে সোনায় বিনিয়োগ করে, কারণ, সোনার দাম পড়লেও পুরোপুরি কখনো শূন্য হয় না।

২। সহজে নগদীকরণযোগ্য সম্পদ

স্বর্ণ হলো এমন একটি সম্পদ যা আপনি যেকোনো সময় বিক্রি করে নগদে রূপান্তর করতে পারেন।
জরুরি মুহূর্তে ব্যাংকে টাকা না থাকলেও, একটি চেইন বা আংটি বিক্রি করে সহজেই অর্থ পাওয়া সম্ভব।

৩। দীর্ঘমেয়াদে মূল্যের বৃদ্ধি

ইতিহাস বলছে, দীর্ঘমেয়াদে স্বর্ণের দাম সবসময় ঊর্ধ্বমুখী।

২০ বছর আগে যেখানে এক ভরি স্বর্ণের দাম ছিল ৫,০০০–৬,০০০ টাকা, এখন তা পৌঁছেছে প্রায় ২ লক্ষ টাকার ওপরে।

অর্থাৎ, সময়ের সাথে সাথে সোনার দাম বেড়েছে প্রায় বহু গুণ!

৪। মুদ্রাস্ফীতি থেকে সুরক্ষা

টাকার মান কমে, কিন্তু স্বর্ণের মান কমে না। যখন দ্রব্যমূল্য বাড়ে, তখন সোনার দামও সাধারণত বাড়ে।
তাই স্বর্ণ হলো মুদ্রাস্ফীতির বিপরীতে এক ধরনের ঢাল।

তাহলে ঝুঁকি কোথায়?

সব বিনিয়োগের মতো স্বর্ণেও কিছু ঝুঁকি ও সীমাবদ্ধতা আছে।

  • তাৎক্ষণিক লাভ পাওয়া কঠিন: স্বর্ণে বিনিয়োগ মূলত দীর্ঘমেয়াদি। এক-দুই মাসে লাভ আশা করা ঠিক নয়।
  • সংরক্ষণ ঝুঁকি: বাসায় বেশি সোনা রাখলে চুরির ঝুঁকি থাকে। ব্যাংক লকার ব্যবহারে আবার অতিরিক্ত খরচ পড়ে।
  • বাজারের ওঠানামা: আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম হঠাৎ কমে গেলে কিছুটা ক্ষতি হতে পারে, বিশেষ করে যারা স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগ করেন।
  • মেকিং চার্জ ও কর: গয়না হিসেবে কেনা সোনার বিক্রির সময় মেকিং চার্জ ফেরত পাওয়া যায় না। ফলে গয়না বিক্রি করে প্রায়ই ক্রয়মূল্যের তুলনায় কিছুটা কম দাম পাওয়া যায়।

স্বর্ণের দাম ক্যালকুলেটর: নিজের দাম নিজেই হিসেব করুন

অনেক সময় আমরা জুয়েলার্সের দোকানে গিয়ে জানতে চাই, আজ ২১ ক্যারেট সোনার ভরি কত? কিন্তু দাম প্রতিদিন ওঠানামা করে, এবং দোকানভেদে সামান্য পার্থক্যও থাকতে পারে।

তাই আপনি চাইলে ঘরে বসেই সহজে স্বর্ণের আনুমানিক দাম নিজে হিসেব করে নিতে পারেন,

একটি সাধারণ “স্বর্ণের দাম ক্যালকুলেশন” পদ্ধতি ব্যবহার করে।

স্বর্ণের দাম ক্যালকুলেটর কী?

স্বর্ণের দাম ক্যালকুলেটর হলো একটি সহজ সূত্র বা অনলাইন টুল, যা দিয়ে আপনি জানতে পারেন, আপনার কাছে যত গ্রাম বা ভরি সোনা আছে, সেটার বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী মোট মূল্য কত।

এই ক্যালকুলেটর ব্যবহার করে আপনি ২১, ২২, বা ১৮ ক্যারেট সোনার দাম আলাদাভাবে জানতে পারবেন,
মেকিং চার্জ যোগ বা বাদ দিতে পারবেন,

এমনকি বিক্রির সময় আনুমানিক কত পাবেন সেটাও হিসেব করতে পারবেন।

ইন্টারনেটে এখন অনেক ফ্রি টুল আছে যেখানে আপনি শুধু ক্যারেট, গ্রাম ও বর্তমান ভরি দাম লিখলেই ফলাফল পেয়ে যাবেন।

শেষকথাঃ স্বর্ণের মূল্যবৃদ্ধির মাঝে কীভাবে সিদ্ধান্ত নেব?

স্বর্ণ শুধু এক টুকরো ধাতু নয়, এটা আমাদের সংস্কৃতি, নিরাপত্তা এবং বিশ্বাসের প্রতীক।

যুগে যুগে মানুষ সোনার প্রতি এমন ভালোবাসা দেখিয়েছে, যেটা অন্য কোনো সম্পদ কখনো পায়নি।

আজকের বিশ্বে অর্থনীতি যত অনিশ্চিত হচ্ছে, স্বর্ণের দাম তত বাড়ছে। এটা হয়তো অনেকের জন্য চাপের, আবার কারও জন্য বিনিয়োগের সুযোগ।

তবে হ্যাঁ, চোখ বন্ধ করে বিনিয়োগ নয়, বাজারের ট্রেন্ড বোঝা, আজকের দাম জানা, এবং নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়াই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।

  • আপনি যদি স্বর্ণ কিনতে চান, BAJUS-এর সর্বশেষ দামের তালিকা দেখে নিন
  • অনলাইন ক্যালকুলেটর ব্যবহার করে নিজের সোনার দাম হিসাব করতে পারেন
  • আর মনে রাখুন, দীর্ঘমেয়াদে স্বর্ণ সবসময়ই নিরাপদ সম্পদ।

শেষে একটা কথাই বলবো, সোনা যেমন ঝলমলে, সঠিক সময়ে সোনায় বিনিয়োগ করাও তেমনই বুদ্ধিমানের কাজ। 

FAQs: স্বর্ণের দাম নিয়ে কিছু সাধারন জিজ্ঞাসা

১। স্বর্ণের দাম আজকের বাজারে কত?

প্রতিদিনের আপডেট দাম জানতে ভিজিট করুন (bajus.org)
এখানে আপনি ১৮, ২১, ও ২২ ক্যারেটের আজকের ভরি বা গ্রাম এর দাম রিয়েল টাইমে দেখতে পাবেন।

২। স্বর্ণের দাম কি কমবে নাকি আরও বাড়বে?

বিশ্ববাজারে মুদ্রাস্ফীতি, ডলারের দরপতন ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সামনের সময়ে স্বর্ণের দাম আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে স্বল্পমেয়াদে সামান্য ওঠানামা স্বাভাবিক বিষয়।

৩। ২১ ক্যারেট ও ২২ ক্যারেট সোনার মধ্যে পার্থক্য কী?

২২ ক্যারেট সোনায় বিশুদ্ধতা প্রায় ৯১.৬৭%, আর ২১ ক্যারেটে ৮৭.৫%। এই বিশুদ্ধতার পার্থক্যের কারণেই ২২ ক্যারেটের দাম তুলনামূলকভাবে বেশি।

৪। বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করে কে?

বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম নির্ধারণ ও ঘোষণা করে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (BAJUS)।

৫। শনাতন সোনা কী এবং এর দাম কম কেন?

শনাতন সোনা হলো স্থানীয়ভাবে মিশ্রণ করা সোনা, যার বিশুদ্ধতা সাধারণত ৮০–৮৩% পর্যন্ত। এটি স্ট্যান্ডার্ড ক্যারেটভিত্তিক না হওয়ায় এর দাম তুলনামূলকভাবে কম হয় এবং বিক্রির সময় কিছুটা কম দাম পাওয়া যায়।

৬। এক ভরি সোনায় কয় গ্রাম?

বাংলাদেশে প্রচলিত হিসাবে ১ ভরি = ১১.৬৬৪ গ্রাম।

আরও পড়ুন